মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ৮টি বইয়ের Summary (FOR BCS )

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ৮টি বইয়ের চুম্বক অংশ !!!!!!!!!
===============================
১। বইয়ের নাম : নাইনটিন সেভেন্টি ওয়ান: আ গ্লোবাল হিস্টরি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ।
.
শ্রীনাথ রাঘবন,ভারতীয় ইতিহাসবিদ ।
রাঘবন লন্ডনের কিংস কলেজের কিংস ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে দেখেছেন উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূরাজনৈতিক সংঘাত হিসেবে। তিনি জোর দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের বৈশ্বিক ইতিহাস প্রণয়নে। এখানে এরই নির্বাচিত অংশ অনূদিত হলো
.....
ঢাকায় দিল্লির ডেপুটি হাইকমিশনার কে সি সেনগুপ্ত সে সময় ছিলেন ভারাক্রান্ত। ১৯৭১-এর ১৪ মার্চ সকালে তিনি শেখ মুজিবের দূত ক্যাপ্টেন সুজাত আলীর সঙ্গে দেখা করলেন। আলীকে পাঠানো হয়েছিল ‘কঠিন মুহূর্তে বিশেষ সাহায্যের আবেদন’ জানাতে। আড়াই ডিভিশন পাকিস্তানি সেনাকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। মুজিব মনে করেন, এটা সম্ভব হয়েছে ‘পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের সুযোগে’। তাঁর বিশ্বাস, ‘ভারত তার সীমান্ত লঙ্ঘনের অজুহাতে পাকিস্তানি সেনা, জাহাজ ও বিমান পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোয় বাধা দিলে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল নাড়া খেত।’ মুজিব অনুরোধ করেন, যাতে ‘এ বিষয়ে ভারত তার সিদ্ধান্ত দ্রুতই জানায়’; যাতে করে তিনি তাঁর ‘পরের পদক্ষেপ কী হবে সেই সিদ্ধান্ত’ নিতে পারেন। ‘পূর্ব পাকিস্তানের আর ফেরার পথ নেই’ জোর দিয়ে বলেন মুজিব। বাঙালিরা ‘সেনাবাহিনীর ওপর আঘাত হানতে প্রস্তুত’ যদি ‘ভারত (পাকিস্তানি সেনার) শক্তি বৃদ্ধিতে বাধা দেয়...স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা ছাড়া মুজিবের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।’
ভারতীয় নেতৃত্বের কাছে এটাই মুজিবের প্রথম বার্তা ছিল না। মার্চের ৫ ও ৬ তারিখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সেনগুপ্তের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি জানতে এসেছিলেন, পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় আক্রমণ চালায় তাহলে মুক্তিসংগ্রামে ভারতীয় সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা? কিন্তু ভারতের তরফে কোনো জবাব না আসায় মুজিব অসন্তুষ্ট হন। সুজাত আলী মুজিবের অসন্তোষের কথা স্পষ্ট করে জানালেন এবং ‘শিগগিরই ভারতের সিদ্ধান্ত’ জানতে চাইলেন। সেনগুপ্ত তখন মুজিবকে খুশি রাখার জন্যই তাঁর সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করতে কলকাতায় গেলেন।
এ সময়ের মধ্যে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র এমন তথ্য পাচ্ছিল যে মুজিব পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাকে সত্যিকার সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচনা করছিলেন এবং তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।...অন্যদিকে ভারত ভয় পাচ্ছিল যে বাংলাদেশ না যেন পশ্চিমবঙ্গ ও আসামকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীন হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ কমিউনিস্টদের হাতে চলে না যায়।
মুজিবের এই বার্তা দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পৌঁছাল ১৯ মার্চ। ইতিমধ্যে সেনগুপ্ত ঢাকায় ফিরলেন এবং তাজউদ্দীনকে ফাঁকা ও গড়পড়তা আশ্বাস দিলেন যে আক্রমণ হলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ‘সব রকমের সহযোগিতা’ দেওয়া হবে। মুজিবের অনুরোধে দিল্লির সাড়া না দেওয়া কিছু গুরুতর প্রশ্ন তোলে। কেন ভারত বিমুখ হয়েছিল? আগেভাগেই হস্তক্ষেপ করা এবং বাঙালিদের পক্ষে থাকাই কি ভারতের জন্য বেশি বাস্তব ও ফলদায়ক নয়? স্বাধীন পূর্ব বাংলা কি ভারতের অবস্থান থেকে খুবই কাঙ্ক্ষিত হওয়া উচিত নয়? ভারতের এহেন আচরণ পরে সংকট সামলানোর চেষ্টায় কী প্রভাব ফেলেছিল?
মুজিবের আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, মধ্য মার্চে ঢাকার সঙ্গে ইসলামাবাদের সমঝোতা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এবং দ্বিতীয়ত, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর থেকে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ায় মুজিবের সত্যিকার অভিপ্রায় সম্পর্কে ভারতীয়দের অন্ধকারে থাকা। সেনগুপ্ত যে বার্তাটি দিল্লিতে পাঠিয়েছিলেন সেখানে বলা ছিল, পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ‘বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপ আমেরিকাকে সাত বছরের জন্য ইজারার বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার নিশ্চিত করায় রাজি ছিলেন।’ এসব কারণে মুজিবের পরিকল্পনা বিষয়ে ভারতীয় নেতৃত্ব সন্দিহান ছিল। যা-ই হোক, মুজিব এর পরে ভারতের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করেননি।
২.
সুইডিশ টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর টেবিলের লাল ফোন বেজে উঠল। তিনি উত্তর করছিলেন, ‘হ্যাঁ,’ ‘হ্যাঁ,’ ‘ধন্যবাদ’। জেনারেল মানেকশ ফোনে জানালেন, ঢাকায় আত্মসমর্পণ সম্পন্ন হয়েছে। মিস গান্ধী তড়িঘড়ি করে পার্লামেন্টের দিকে ছুটলেন। পুরো সভা উত্তেজনা ও আগ্রহ নিয়ে শুনল: ‘পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করেছে...ঢাকা এখন মুক্ত দেশের মুক্ত রাজধানী।’
পাকিস্তানে এর অভিঘাত বিদ্যুতের কামড় খাওয়ার মতো। ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনী বিমর্ষভাবে রাষ্ট্রের হাতল তুলে দিয়েছিল জুলফিকার আলী ভুট্টোর হাতে। তিনি এখন প্রেসিডেন্ট এবং সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি ভুট্টো ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিদায় দিতে যান। দুই দিন পরে, ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি বিমানবন্দরের টারমাকে দঁাড়িয়ে মুজিবকে স্বাগত জানান। দুই নেতা বিপুল জনগণের সামনে দু্ই দেশের বন্ধুত্ব ও বিশ্বস্ততা দীর্ঘজীবী হওয়ার অঙ্গীকার করেন। মুজিব ঢাকায় অবতরণ করেন সেদিন বিকেলেই। লাখো মানুষের বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে মুজিব দেশে ফিরলেন। ভারত কেবল চূড়ান্ত বিজয়ই পায়নি, পাশাপাশি ১৯৪৭ সাল থেকে উপমহাদেশকে তাড়িয়ে বেড়ানো ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ ভূতও ঝেড়ে ফেলল। বাংলাদেশ খুনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মুক্তি অর্জন করল। এই আবেগ এখনো দুই দেশে বিদ্যমান।
তবে বাংলাদেশের আবির্ভাব অনিবার্য ছিল; এমন মনোভাবের জন্ম আসলে যুদ্ধের পরের সময়ে। আপাত অকাট্য ও নিয়তিবাদী এ চিন্তা কিন্তু একাত্তরের আগে তেমন মাটি পায়নি। এ রকম অনিবার্যতাবাদী ভাবনা–যুদ্ধের পরিণতির আগাম নিশ্চয়তা খুঁজে নেওয়ার মাধ্যমে আসলে একে বুঝতে সমস্যাই সৃষ্টি করে। কার্যত, ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ভাঙন অথবা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনিবার্য ছিল না। বরং এটা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার আওতার বাইরে বয়ে চলা ঐতিহাসিক স্রোত ও সংযোগের ফল। তা ছাড়া বিউপনিবেশীকরণ, শীতল যুদ্ধ এবং উদীয়মান বিশ্বায়ন দক্ষিণ এশীয় সংকটের সঙ্গে এমনভাবে ক্রিয়া করেছিল, যার পরিণতি অনুমান করা সম্ভব ছিল না।
আন্তর্জাতিক টানাপোড়েন এবং পরাশক্তিগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা ও পক্ষবদল যেমন বিরাট প্রভাবক ছিল, তেমনি ১৯৬৮ সালের বৈশ্বিক যুববিদ্রোহও বাঙালিদের দৃঢ়চেতা করে তুলেছিল। আটষট্টির বৈশ্বিক ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবে পাকিস্তানি ছাত্ররা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আইয়ুব খানকেই শুধু ক্ষমতাচ্যুত করেনি, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকেও আপসহীন করে তুলেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগও এর শক্তিতেই ছয় দফা দাবিকে নরম করতে অথবা শাসকদের সঙ্গে অতীতের কায়দায় মানিয়ে নিতে রাজি ছিল না। তারপরও, স্বাধীনতার গন্তব্যের কোনো মসৃণ ও সোজা পথ ছিল না। হোর্হে লুই বোর্হেসের কল্পনা ধার করে বলা যায়, এটা ছিল গোলকধাঁধার বাগানের পথ।
যেমন, ভুট্টো যদি আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহণ ঠেকাতে সামরিক শাসকদের দোসর না হতেন, তাহলে শিথিল ফেডারেশনের মতো করে হলেও পাকিস্তান টিকত। ভুট্টোর মদদ ছাড়া সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানকে দমনের সময় পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হতো না। আইয়ুব খানের উচ্ছেদের ঘটনাই প্রমাণ করে, একসঙ্গে দুই পাকিস্তানে গণ-অভ্যুত্থান দমন করা অসম্ভব। ভুট্টো যদি মুজিবের সঙ্গে যোগ দিতেন, যেমনটা সমসাময়িক অনেকে আশা করেছিলেন, তাহলে পাকিস্তানের ভাঙন এড়ানো সম্ভব হতো।
যদি নিক্সন প্রশাসন এপ্রিলের শেষে বা মের প্রথমে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া বন্ধের হুমকি দিত, তাহলে খুবই সম্ভব ইয়াহিয়া গং মুজিবের সঙ্গে আপসে আসতে বাধ্য হতো এবং ছয় দফা মেনে নিত। এ সময়ের মধ্যে সামরিক দমন-পীড়ন এমন জায়গায় যায়নি, সেখানে কনফেডারেশনের প্রস্তাব আওয়ামী লীগের কাছেও অগ্রহণযোগ্য হতো।
অক্টোবরের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান বদলে না গেলে ভারতও হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের বড় নদীগুলোর তীরে পৌঁছানোর পরিকল্পনা নিত না। তেমনি ব্রিটিশ ও ফরাসি সমর্থন না পেলে ভারত হয়তো সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের রাস্তা নিত না। যদি চীনা নেতৃত্ব ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণ বৈরিতা এড়াতে না চাইত, কিংবা তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দ্বন্দ্বে না ভুগত, তাহলে ভারতও পাকিস্তানের পক্ষে চীনা অভিযান না-হওয়ার আত্মবিশ্বাস পেত না। ৩ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ভুল না করলে ঢাকা দখল ও পরিপূর্ণ বিজয়ের লক্ষ্য নিত না ভারত।
একেবারে শেষ মুহূর্তে ভুট্টো যদি নিরাপত্তা পরিষদে পোল্যান্ডের প্রস্তাব আবর্জনার স্তূপে ছুড়ে না ফেলতেন, তাহলে ভারতীয় বাহিনীকে ঢাকার অনেক আগেই থেমে যেতে হতো। তাহলে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ কিংবা ৯৩ হাজার সেনা যুদ্ধবন্দী হতো না। এর চেয়েও যা বড়, তড়িঘড়ি ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের ফলে ভারতের পক্ষে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরও এত নিশ্চিত থাকত না যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ যে ‘সম্পূর্ণ বেসামরিক নৈরাজ্যের মধ্যে’ পড়বে, সে বিষয়ে ভারত ভালোভাবেই সজ্ঞান ছিল।
==============================
=====================================
২। বইয়ের নাম : ‘উইমেন, ওয়ার অ্যান্ড দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ : রিমেম্বারিং ১৯৭১।
.লেখক : অধ্যাপক ইয়াসমিন সাইকিয়া
অ্যারাইজনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক
.
ভারতের অহমীয় ইতিহাসবিদ ইয়াসমিন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ছায়ায় বেড়ে উঠেছেন এবং এ বিষয়ে তিন বছরের একটি কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকে বইটি প্রকাশ করেছেন। এখানে এরই নির্বাচিত অংশ অনূদিত হলো।
..................
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বহুমুখী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিতীয় যুদ্ধ এবং বাঙালি ও উর্দুভাষী বিহারিদের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ হয়েছিল। আর চূড়ান্তভাবে একটি অব্যাহত যুদ্ধ হলো পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় নারীদের বিরুদ্ধে।...যুদ্ধ শেষে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তান শাসনে তারা তাদের বৈধতা হারাল। আন্তর্জাতিক যুদ্ধ পাকিস্তানের বিভক্তি অনিবার্য করল। অভ্যুদয় ঘটাল স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের। জাতিগত যুদ্ধ বিহারিদের নাগরিক থেকে রূপান্তরিত করল রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তুতে এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সমাজের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যা বহুমুখী প্রান্তিক সম্প্রদায়ের জন্ম দিল।
আজ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাসের বইয়ে বহুভাবে একাত্তরের যুদ্ধকে স্মরণ করা হয়। বাংলাদেশে এটা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ হিসেবে উদ্‌যাপিত হয় এবং এটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটাল। ভারতীয় ইতিহাসে ১৯৭১ চিহ্নিত হয়ে আছে ‘ভারত-পাকিস্তান’ যুদ্ধ হিসেবে। সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে শোধ নেওয়ার একটা অপূর্ব মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে একে দেখা হয় ভারতে।
পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের ঘটনাবলিকে ভুলে যেতে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সে কারণে পাকিস্তানে আজ অল্পসংখ্যক মানুষই স্মরণ করতে পারে যে পূর্ব পাকিস্তান একদা অবিভক্ত পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। বাঙালিরা সাধারণভাবে এই যুদ্ধকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে গণ্য করে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের জাতীয় ইতিহাস লেখার একটি অভিন্ন প্রবণতা হলো পরস্পরকে দোষারোপ করা। প্রায় চার দশক পরে ‘আমাদের’ যুগল স্মৃতি, যেটা ভালো বনাম মন্দকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে, সেখানে সরলীকরণ
খুবই স্পষ্ট। বিভীষিকাপূর্ণ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃষ্টিতে কী ধরনের জটিলতা ভূমিকা রেখেছিল এবং নারীর জীবনে সহিংসতা ও সন্ত্রাস কী প্রভাব ফেলেছিল, সেসব খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তাকে আজও অগ্রাহ্য করা হয়।
...সহিংসতা কেবলই যুদ্ধের সশস্ত্র অস্ত্রগুলোর মধ্যে সীমিত থাকেনি। সহিংসতা নিরীহ জনগণের ওপর গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। সব বয়সের নিরস্ত্র মানুষ, বিশেষ করে নারী, যাঁরা আগ্রাসনকারীদের কোনো ক্ষতি করেননি, তাঁদের জীবন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তাই চূড়ান্ত বিচারে ১৯৭১ সালে এমন একটি যুদ্ধ হয়নি, যেটা কেবল পুরুষের বিরুদ্ধে পুরুষ করেছে, সেই যুদ্ধ ছিল অসহায় প্রবীণ, নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি অপরাধ।
.
আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা করতে গিয়ে কথ্য ইতিহাস, প্রামাণ্যচিত্র, আর্কাইভে রাখা উপকরণের সাহায্য নিয়েছি, তবে আমি যুদ্ধের ভেতরের সেসব অবয়ব দেখতে সচেষ্ট হয়েছি, যেগুলো এখনো প্রকাশ্যে আসেনি।
.
নারী নিগ্রহের ইতিহাস অনেকটাই চাপা পড়ে আছে। সেগুলো হারিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে। রাখা হয়েছে স্মৃতির গোপন কুঠুরিতে। কারণ, নারীরা যুদ্ধে সন্ত্রাস ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যুদ্ধ তাঁদের প্রান্তিকজনে পরিণত করেছে। তাঁদের গল্পগুলো একটি মানবিক কণ্ঠস্বর সৃষ্টি করেছে। আর সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যাঁরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, তাঁদের অভিজ্ঞতা মূর্ত হয়েছে। সরকারিভাবে লেখা ইতিহাসে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার যে বিবরণ এসেছে, তা পাঠ করে নারীর প্রতি যে নৃশংসতা ঘটেছে, সেটা উপলব্ধি করা একপ্রকার অসম্ভব। তদুপরি সরকারি ইতিহাসে যেটুকু মিলেমিশে গ্রন্থিত হয়েছে, তা আবার জনগণের সমষ্টিগত স্মৃতি থেকে উবে গেছে এবং হিংসাশ্রয়ী অতীত সম্পর্কে সচেতনতা হারিয়ে গেছে।
.
একজন দক্ষিণ এশীয় মানুষ হিসেবে আমি নারী নিগ্রহ-বিষয়ক স্মৃতিচারণার বিড়ম্বনা বেশ অনুধাবন করতে পারি। পুরুষেরা বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যান। গোপনীয় ও বিস্মৃত অতীত নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি, নৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং সমাজতাত্ত্বিক জটিলতা সৃষ্টি করে। সুতরাং একদিকে এসবের স্মৃতিচারণার যেমন দরকার রয়েছে, অন্যদিকে যুদ্ধের সহিংসতার অধ্যায় ভুলে যাওয়ার অভিপ্রায়ও রয়েছে। এ বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান করতে গেলে আপনাকে ইতিহাস এবং ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে যেতে হবে। এটা আতঙ্কমূলক কারণ অনুসন্ধানের ফলে আমাদের সময় এবং আমাদেরই পিতামাতার উপাখ্যানসমূহ উন্মোচিত হবে। আমরা সমগ্র প্রজন্মকে ‘সংখ্যালঘুর’ অপরাধ এবং তাদের কার্যক্রমের সাক্ষী হতে বলতে পারি না। সম্ভবত আমরা এটা ভেবেও শঙ্কিত যে আমরা আমাদের ভেতরেই একসঙ্গে ভুক্তভোগী এবং দুষ্কৃতকারী খুঁজে পেতে পারি। আমরা তাই একাত্তরের নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাবলিকে এমনভাবে পেছনে ঠেলছি যে ওটা বুঝি ‘অন্য কারও ইতিহাস’ কিংবা ‘সেসব এমনকি কোনো ইতিহাসই নয়’। আমরা কি এ রকম প্রত্যাখ্যান এবং বর্জনের নীতি অনুসরণ করে বেঁচে থাকতে পারব?
.
আবার যে কাহিনি সুবিদিত, দালিলিক, মহাফেজখানায় রক্ষিত ‘ইতিহাস’, যা ১৯৭১ সালে কী ঘটেছিল তার সাক্ষ্য দেবে, সেখানে কোনো অলৌকিক সত্যে পৌঁছানো আমার লক্ষ্য নয়। এর পরিবর্তে আমি তাই নির্যাতিত, ভুক্তভোগী নারীর জবানবন্দির ওপর নির্ভর করেছি। এর লক্ষ্য হলো যুদ্ধের মানবিক মূল্য নিরূপণ করা এবং এটা খতিয়ে দেখা যে মানুষ কীভাবে ঘটে যাওয়া সহিংসতার ক্ষতগুলোকে মোকাবিলা করে এবং তা থেকে তারা কী শিক্ষা গ্রহণ করে? আমি নারী-পুরুষের মানবিক কণ্ঠের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছি, বিশেষ করে যাঁরা সহিংসতার ভস্ম থেকে উঠে এসেছেন। যাঁরা আমাদের মানবতার নতুন দীক্ষা দিয়েছেন।
.
একাত্তরের ভয়ংকর সহিংসতার বিষয়ে বাংলাদেশের নারীর যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সেটা একই সঙ্গে পুরুষের জন্য প্রকাশ্য জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ। আবার একই সঙ্গে সেটাই জাতির জন্য ‘লজ্জা’র এবং গোপনীয়। বহুস্তরবিশিষ্ট এই মুহূর্তগুলো, যেমনটা এই নারীরা অনুধাবন করতে পেরেছেন, তাঁরা তার বিবরণ দিয়েছেন। আর তাঁরা তাঁদের সেই ভয়াল অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে সমাজে নিজের জন্য একটা শূন্যতাও সৃষ্টি করেছেন। আর সেই শূন্যতায় বসবাস করতে হয় কেবল তাঁকেই।...নারীর স্মৃতিচারণাকে কোনো একটি শ্রেণির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা চলে না। বিশ্লেষণমূলক কোনো বেষ্টনীতে তাঁকে আটকে রাখা যায় না। আমাদের তাই তাঁদের সম্পৃক্ত করার উপায় উদ্ভাবন করতে হবে, যাতে তাঁরা অতীতের প্রোথিত গল্প (এমবেডেড স্টোরি) খননের কণ্ঠস্বরে পরিণত হওয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে পারেন।
.
... সরকারি ইতিহাস যেখানে আংশিক বা সম্পূর্ণ স্মৃতিবিলোপ ঘটেছে, সেখানে আমি বাংলাদেশি নারীর নীরব জবানবন্দির দিকে নজর দিলাম। তাঁদের স্মৃতি এই আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করেছে যে, একাত্তর আসলে এই উপমহাদেশের জন্য কী অর্থ বয়ে এনেছে। স্মৃতি কীভাবে এই অঞ্চলের উন্নত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অধিকতর অর্থবহ এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। একাত্তরের ইতিহাসের নিখোঁজ অংশগুলো জোড়া দিয়ে নারীরা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা পরিবর্তনের এজেন্ট এবং তাঁরাই নতুন করে একটি অধ্যায়ের সূত্রপাত করতে পারেন। তাঁদের এই মানবিক কর্ম, এই বলা, একাত্তরের গণইতিহাস তৈরির পথে প্রথম পদক্ষেপ।
.
...সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নারীর স্মৃতিচারণা আমাদের গভীরভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় যে তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনে সক্ষম। তাঁরা অতীত মোকাবিলায় সবল। তাঁরা সামনে এগোতে জানেন। তাঁরাই হতে পারেন একটি নতুন ভবিষ্যতের উদগাতা। নারীরা যে সত্য বলছেন সেটা প্রকারান্তরে আমাদের শাস্তিযোগ্যতার দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। কারণ, আমরা তাঁদের ওপর এক অমানুষিক নীরবতা চাপিয়ে দিয়েছি। ঔপনেবিশকতা–পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের নিজেদের জানার প্রয়োজনেও তাঁদের গল্পগুলো আমাদের শোনা দরকার। বিশেষ করে, আমরা যদি এই অঞ্চলের কোনো একটি অংশকেও বদলে দিতে চাই।
======================================
৩। বইয়ের নাম : স্প্রিং ১৯৭১
ফারুক আজিজ খান
১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ছিলেন।
..........
সত্যি কথা বলতে কি, অক্টোবরের শেষ দিকে বা নভেম্বরের প্রথম দিকেই সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ওই সময়টাতেই ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ) বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় একযোগে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালায় এবং বহু এলাকা মুক্ত করে। দুই পক্ষেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘তিনি [ইন্দিরা গান্ধী] ৪ নভেম্বর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন, যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে...।’ ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভারত আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়া খান যুদ্ধকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেন।
ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সমন্বিতভাবে উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব—এই তিন দিক থেকে আক্রমণ রচনা করে। তবে দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা বাদ রাখা হয়। আর ভারতীয় বাহিনীর মূল কৌশল ছিল, যত দূর সম্ভব পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে দ্রুত সময়ে ঢাকা দখল করে নেওয়া। তবে যশোরে প্রচণ্ড সংঘর্ষের আশঙ্কা ছিল। কেননা, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রসহ যশোর ক্যান্টনমেন্ট ‘নিয়াজির দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত ছিল। পাকিস্তানি ব্রিগেড এখানে ভারতীয় আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু ৭ ডিসেম্বর যখন যশোর সেনানিবাসের পতন ঘটল, তখন তেমন কোনো প্রতিরোধই তৈরি করা হয়নি। এই অভিযানে অংশ নেওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাকে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা একটা গুলিও ছোড়েনি।’ বরং তারা নিরাপদ অবস্থানে সরে যায়। আসলে তারা বুঝতে পেরেছিল যে বাধা দিয়ে কোনো লাভ নেই, কেবল ক্ষয়ক্ষতিই বাড়বে। কোনোভাবেই জয়লাভ করা যাবে না। এ ঘটনার পর গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে নিয়াজি নাকি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। বয়োবৃদ্ধ গভর্নর মালিক তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আমি জানি জেনারেল সাহেব, একজন সেনাপতির জীবনে কঠিন সময় আসে। তবে সাহস হারাবেন না। খোদা আমাদের সঙ্গে আছেন।’ শক্তিশালী ভারতীয় বিমানবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী কার্যত কোনো যুদ্ধই করতে পারেনি। যশোর সেনানিবাস পতনের আগের দিন ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বিমানবাহিনীকে পুরোপুরি মাটিতে বসিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে বোমাবর্ষণ করে তা অকেজো করে দেয় ভারতীয় বিমানবাহিনী।
উত্তর রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর শেরপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ৭ ডিসেম্বর জেনারেল অরোরা উড়ে আসেন শেরপুরে পরিস্থিতি দেখতে।
আমরা অবশ্য ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলাম। কেননা, তিন দিন পেরিয়ে গেলেও ভারতের দিক থেকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো আভাস মিলছিল না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ জানান। শেষ পর্যন্ত ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। বহুপ্রতীক্ষিত এই সংবাদ আসার পর সবাই উল্লাসে ফেটে পড়েন। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য কর্মকর্তা আলী তারেক আরও কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে গিয়ে ৮ থিয়েটার রোডের মূল ভবনের সামনে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে দেন। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। উত্তর দিক থেকে বয়ে আসা হিমেল হাওয়ায় পতাকাটি যখন পতপত করে উড়ছিল, তখন আশপাশে সবাই উল্লসিত জয়ধ্বনিতে চারপাশ প্রকম্পিত করে তোলেন। ওই সময় বাংলাদেশ কার্যালয় প্রাঙ্গণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানী। আমরা এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটিতে তাঁকে অভিনন্দন জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে আমি তখন বয়োজ্যেষ্ঠ। আমাকেই বলা হলো কর্নেল ওসমানী ও তাঁর এডিসি লেফটেন্যান্ট শেখ কামালকে মালা প্রদান করতে। আর শেখ কামালকে (বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত) বলা হলো তাঁর ঊর্ধ্বতনকে ফুলের তোড়া প্রদান করতে। অফিসের একজন আলোকচিত্রী কয়েকটি ছবিও তুলেছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় (ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ) ৬ ডিসেম্বর দিনের প্রথম ভাগে এক বিবৃতি দেন। তাতে তিনি বলেন, ‘প্রবল প্রতিকূলতার মুখেও বাংলাদেশের মানুষের যে বীরত্বপূর্ণ লড়াই, তা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন একটি অধ্যায় যুক্ত করেছে। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মিলে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়েছে, যেখানে আরও যোগ দিয়েছে পূর্ব বাংলার হাজার হাজার তরুণ, যারা স্বাধীনতার জন্য ও দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যে ঐক্য, প্রত্যয় ও সাহস নিয়ে বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী লড়াই করেছে, দুনিয়াজোড়া গণমাধ্যমে তা উঠে এসেছে।’
ওই দিন ভারতের লোকসভায় উপস্থিত ছিলেন দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিক এইচ [হুমায়ুন] রশিদ চৌধুরী। পাকিস্তান ভেঙে যাচ্ছে, এটা নিশ্চিত হয়ে তিনি সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করেন। তাঁকে লোকসভায় মাল্যভূষিত করা হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় তিনি সুন্দরভাবে ইন্দিরা গান্ধীর প্রশংসা করেন এবং বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি শুধু ভারতের নেত্রী নন, আপনি বিশ্বেরও একজন নেত্রী।’ তাঁর বক্তৃতার জন্য তিনি উচ্ছ্বসিত সংবর্ধনাও পান।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্যও কিছু ফুল এনে অফিসে রাখা হয়। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, অফিসে ফিরবেন তা আমরা জানতাম। বিকেল চারটার দিকে কালো রঙের একটি অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে থিয়েটার রোড কার্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন তিনি। পেছনে ছিল প্রহরা গাড়ি। জলপাই সবুজ রঙের সাফারি স্যুট পরা তাজউদ্দীন গাড়ি থেকে নামলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় ইন্দিরা গান্ধী’ স্লোগানে মুখর হয়ে উঠল গোটা প্রাঙ্গণ। উপস্থিত জনতা ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করল দুই নেতাকে। আমরা সেই মুহূর্তটিকে সারা জীবন মনে রাখব।...
যশোর সেনানিবাসের পতন হওয়ার পরও পাকিস্তান রেডিওর খবর শুনে কলকাতার মুসলমানরা পাকিস্তানের জয় উদ্যাপন করেছিল মিষ্টি বিলিয়ে। জুমার নামাজে পাকিস্তানের জয়ের জন্য প্রকাশ্যে প্রার্থনা করা হয়।
পরদিন ৭ ডিসেম্বর বেলা তিনটার দিকে কলকাতায় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পি এন ব্যানার্জি প্রধানমন্ত্রীর [তাজউদ্দীন আহমদ] সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ভবনের আঙিনামুখী সিঁড়িতে বসে আমি স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখছিলাম। লোকজন তেমন ছিল না। আমাকে দেখে ব্যানার্জি বাবু জানতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী আছেন কি না। ‘জি আছেন, আপনি ভেতরে যান।’ বললাম আমি। কয়েক মিনিট পর তিনি বেরিয়ে এলেন এবং ইশারায় বিদায় জানালেন। এক সেকেন্ডের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর দপ্তর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমার কাছে এসে আমাকে একটি চিঠি দিয়ে বললেন, ‘পড়ুন।’ চশমা আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই চিঠি চোখের কাছে এনে পড়ার চেষ্টা করলাম। প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর নিজের চশমাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা দিয়ে চেষ্টা করুন।’ আমি তাঁর চশমাটা চোখে এঁটে চিঠিটি পড়তে লাগলাম। ‘খুব চমৎকার চিঠি,’ তিনি বললেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী চিঠিটি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর নিবেদিত নেতৃত্বের জন্য। পরদিন ৮ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে সবাই উল্লসিত হয়ে ওঠেন।
==========================
=============================
৪। বইয়ের নাম : ইন সার্চ অব সলিউশনস:অ্যান অটো বায়ো গ্রাফি অব মীর গাউস বখশ বিজেনজো
.
গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অব্যবহিত আগে বিরাজমান অচলাবস্থা নিরসনে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। লেখক মীর গাউস বখশ বিজেনজো অবিভক্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা ছিলেন। ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক শুরুর আগে তিনি স্বেচ্ছায় ঢাকায় এসে বরফ গলানোর চেষ্টা করেছেন। তারই চুম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হলো।
.
যাঁরা চাচ্ছিলেন আমি পূর্ব পাকিস্তানে যাই, তাঁদের মধ্যে সংবাদ সংস্থা পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের (পিপিআই) মুয়াজ্জাম আলীও একজন। তিনি বলেন, তাঁর একটি টেলেক্স যন্ত্র তখনো কাজ করছে। তিনি ঢাকায় বার্তা পাঠাতে পারবেন। আমি তাঁকে অনুরোধ করি, তিনি যেন শেখ মুজিবকে টেলেক্স করে জানান, তিনি প্রয়োজন বোধ করলে আমি পূর্ব পাকিস্তানে যেতে পারি।
পরের দিন মুয়াজ্জাম আলী শেখের প্রত্যুত্তরের কথা জানান। শেখ বলেছেন, আমি ঢাকায় গিয়ে তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করলে তিনি খুবই খুশি হবেন। ফলে, ঢাকায় যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় রইল না। আমার ঢাকা সফর ফলপ্রসূ হবে না জেনেও ঢাকার একটি টিকিট কিনলাম। অপ্রত্যাশিতভাবে ন্যাপ নেতা ওয়ালি খান সেদিনই লন্ডন থেকে করাচি আসেন। আমার সব বন্ধু তাঁকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন আমার সঙ্গে ঢাকায় যান। আমিও চাইলাম, তিনি যেন আমার সঙ্গে ঢাকায় যান। খানসাহেবও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিনা নোটিশে আমার সঙ্গে ঢাকায় যেতে সম্মত হন।
১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ আমরা ঢাকায় অবতরণ করি। বিমানবন্দর থেকে আমরা সরাসরি আমাদের চির অভ্যর্থনাকারী ও পার্টি নেতা আহমদুল কবির ও লায়লা কবিরের বাসায় যাই। সেখান থেকে আমরা শেখ মুজিবকে ফোন করি। ওয়ালি খান আমার সঙ্গে এসেছেন শুনে তিনি খুব খুশি হন। তাঁর কণ্ঠ শুনে তাঁকে শান্তই মনে হয়। কিন্তু তিনি সখেদে বলেন, ‘আপনারা আমার অতিথি। আপনাদের আমার বাসায় ওঠা উচিত। অথচ আপনারা কখন আসবেন তা আমাকে জানালেনও না।’ আমি বললাম, ‘আহমদুল কবির আমাদের অপরিচিত নন। তিনি আপনারও বন্ধু।’ পরবর্তী দিন আমাদের বৈঠকের সূচি নির্ধারিত হয়।
নির্ধারিত সময়ে আমরা শেখ মুজিবের বাড়িতে পৌঁছাই। তিনি অত্যন্ত উষ্ণতার সঙ্গে আমাদের বরণ করেন। বসার পরই আমি সোজাসুজি মূল কথায় চলে যাই। আমি শেখ মুজিবকে বলি:
পশ্চিম পাকিস্তানে যারা আপনার রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, আমরা তেমনই দুজন মানুষ। ফলে, আশা করি আপনার পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাদের খোলাখুলি বলবেন। আপনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। আপনার হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। কিন্তু আপনি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা (ইউনিল্যাটেরাল ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স—ইউডিআই) করলে আমাদের কী কঠিন সমস্যায় পড়তে হবে, তা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারেন।
এ কথা শুনে শেখ মুজিব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বলেন:
কে কাকে পাকিস্তান না ভাঙার ব্যাপারে বলছে? আপনারা যাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন (দেশভাগের আগে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের সংস্রবের প্রতি ইঙ্গিত করে) তাঁরা আমাকে এ কথা বলছেন। আমি ছিলাম কট্টর মুসলিম লিগার। পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য অনেক ত্যাগ আমি করেছি। নিয়তির কী পরিহাস?
ওয়ালি খান হস্তক্ষেপ করে তাঁর বৈশিষ্ট্যসূচক রসপূর্ণ ভঙ্গিতে বলেন:
আমরা বলেছিলাম, ভারত ভেঙে পাকিস্তান বানাবেন না। কিন্তু আপনারা ছিলেন অনড়। পাকিস্তান না বানিয়ে আপনারা ঘরে ফিরবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এখন জোড়হস্তে প্রার্থনা করছি, দয়া করে পাকিস্তান ভাঙবেন না। কিন্তু আপনি বলছেন, পাকিস্তান ভাঙবেন। আপনারা মুসলিম লিগাররা সত্যিই এক বিশেষ প্রজাতির মানুষ।
শেষমেশ আমরা মূল কথায় আসি। অবস্থা খুব গুরুতর। ফলে, তিনি যদি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন, তাহলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। আমরা বললাম, তাঁর উচিত ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বসে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ বাতলানো। রাষ্ট্রের কর্ণধার সংকট নিরসনে একেবারেই অক্ষম। শেখসাহেব জবাবে বলেন:
আমি আপনাদের বলি, ইয়াহিয়া খান ও তার সঙ্গীরা কখনোই আমার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তার জন্য পাকিস্তান ভেঙে গেলেও তাদের কিছু আসবে যাবে না। আমার হাতে ক্ষমতা আসবে, পাঞ্জাব সেটা সহ্য করবে না।
আমরা দেখলাম, শেখ মুজিবের মনে গভীর মর্মবেদনা। তাঁর কণ্ঠে দুঃখের সুর খুবই স্পষ্ট:
আমি একটি শর্তে চেষ্টা করতে পারি। আলোচনা যত দিন চলবে, তত দিন আপনারা দুজন ঢাকায় থাকবেন। আরও একটি বিষয়। আপনারা আমার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমিও আপনাদের সঙ্গে বের হব। কিন্তু জনসমক্ষে বলব না, আমি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।
তিনি বাড়ির উঠানে বেরিয়ে এলে স্থানীয় ও বিদেশি সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিল। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে শেখ মুজিব অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করবেন। আমরাসহ উপস্থিত সবাই অবিশ্বাসভরে সে কথা শুনলাম। তিনি এও বলেন, রাষ্ট্রপতি যেখানে তাঁকে ডাকবেন, তিনি সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন।
পরের দিন ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। তিনি গভর্নমেন্ট হাউসে ওয়ালি খান ও আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আহ্বান করেন। আমরা তাঁকে বলি, শেখ মুজিবের মনে পাকিস্তান ভাঙার কোনো অভিপ্রায় নেই। আমরা আরও বলি, পাকিস্তানের সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনপ্রাপ্ত দলের নেতা হচ্ছেন শেখ মুজিব। ফলে, তিনি আইনসংগতভাবেই ক্ষমতার দাবিদার। তাঁর দাবি যৌক্তিক। শেখ মুজিবের মতো তিনিও আমাদের আলোচনা চলা পর্যন্ত ঢাকায় থাকার আহ্বান জানান।
এ অবস্থায় ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক শুরু হয়। শেখ সাহেব বৈঠক সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেছেন। প্রথম কয়েক দিন বেশ নির্ঝঞ্ঝাটেই পার হয়। এরপর ইয়হিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলকেই ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান। ইয়াহিয়া অর্থসচিবকেও ডেকে পাঠান। এ কথা শোনার পর শেখ মুজিব শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। কারণ, ভুট্টো ও এম এম আহমেদের আগমন হয়তো শুধু এই আলোচনায় অন্তরায় সৃষ্টি করা।
ঢাকায় এসেই ভুট্টো তাঁর পিপিপির একটি প্রতিনিধিদল আমাদের কাছে পাঠান। লক্ষ্য হচ্ছে, এই আলোচনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তানের দলগুলোর একটি অভিন্ন অবস্থান তৈরি করা। আমরা সে প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমরা এও জানতাম, ভুট্টো ঢাকায় এসেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা চক্রের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে। একই সঙ্গে নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করাও ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর দুরভিসন্ধি ছিল এ রকম, তাঁকে ক্ষমতার ভাগ দেওয়া না হলে এই আলোচনায় অন্তরায় সৃষ্টি করা। শক্তি প্রয়োগ করে শেখ মুজিব ও তাঁর দলকে বাগে আনতে ইয়াহিয়া খানকে তিনি প্ররোচনা দিতে পারেন। এ উপায়ে নিজের অবস্থান শক্ত করতে যদি পাকিস্তান ভেঙেও যায়, তাহলেও তাঁর কিছু আসে-যায় না।
এরপর আলোচনা এক ভিন্ন মোড় নেয়। ইয়াহিয়া খান বলেন, লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের শর্তাবলি পূরণ হলে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। শেখ মুজিব বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে দুটি সভা আহ্বান করা হোক। তারা দুই অংশের জন্য পৃথক সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করবে। তারপর একত্রে বসে তারা ফেডারেল পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করবে।
শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাদের জানান, জেনারেলের মনোভাব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। তাঁর মন-মর্জি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বলেন:
আমি আর একটি বা দুটি সংসদ আহ্বানের কথা বলব না। আমি অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করব। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনপ্রাপ্ত দলের নেতা হিসেবে আমি সংসদ অধিবেশন ডাকব। মূল কথা হচ্ছে, সামরিক আইন প্রত্যাহার করে আমার দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ইয়াহিয়া খানকে এ কথা জানালে তিনি বলেন, ‘আপনাদের বন্ধু মুজিব যদি ঠিকঠাক আচরণ না করে, তাহলে আমার সেনারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সেনানিবাস থেকে বের হবে।’ তাঁর মনে কী আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তারপর ২৪ মার্চ শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি সেই ভয়ংকর খবরটি দেন, ‘সেনাবাহিনী আগামী দুই দিন আমাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে। আপনাদের আর কাজ নেই, আপনারা চলে যান।’ হতভম্ব ও নির্বাক হয়ে আমরা তাঁর বাড়ি ছেড়ে আমাদের জায়গায় চলে আসি
===================================
===========================================
৫। বইয়ের নাম : কোয়াইট ডিপ্লোমেসি: মেমোয়ার্স অব এ পাকিস্তানি ডিপ্লোম্যাট
জামশেদ মার্কার
.
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে জামশেদ মার্কার ছিলেন মস্কোয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতির গতিবিধি এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা আলোচিত হয়েছে তাঁর কোয়াইট ডিপ্লোমেসি: মেমোয়ার্স অব এ পাকিস্তানি ডিপ্লোম্যাট বইয়ে
...........
১৬ নভেম্বর রুটিন বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জ্যাকব বিম আমাকে বললেন, তুমি কি জানো, তোমার প্রেসিডেন্ট (ইয়াহিয়া খান) বাংলাদেশের কতিপয় নেতার সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে এবং আশা করি সেই আলোচনা একটি রাজনৈতিক ফয়সালার দিকে নিয়ে যাবে। রাষ্ট্রদূত বিমকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে পেছনের ঘটনাবলি সোভিয়েতদের জানানো হোক, যাতে তারা ভারতীয়দের নিবৃত্ত করে।
আমি অবশ্যই এই অগ্রগতি সম্পর্কে কিছুই জানতাম না এবং বিক্ষুব্ধ হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। আমরা কী করেছি, কী করিনি সেটাই এর মাধ্যমে পরিষ্কার হলো; বিশেষ করে সরকার ও একজন রাষ্ট্রদূতের মধ্যকার যোগাযোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে। বিম আমাকে জানালেন, এসব ঘটনা তিনি প্রথম উপপরাষ্ট্রমন্ত্রী কুৎজনেতভকে বলেছেন; তাঁকে দৃশ্যত আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে হলেও দিল্লিকে নিবৃত্ত করার পরামর্শে সাড়া দেননি।
যদিও ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীর অভিযান আলোচনার বিষয়টি পেছনে ফেলে দেয়। আমি নিজের উদ্যোগে তিন দিনের জন্য ইসলামাবাদে যাই পরামর্শের জন্য; সেখানে আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল গোলাম জিলানি খানসহ বিভিন্ন জনের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করি। জিলানি আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক ফয়সালার কথাই বলেছিলেন।
মস্কো ফিরে আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশীয় ডেস্কের প্রধান এ এ ফোমিনকে বিষয়টি জানাই এবং সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আগেই যুদ্ধবিরতি ও সেনা প্রত্যাহারের ওপর জোর দিই। কিন্তু ফোমিন ছিলেন আত্মরক্ষামূলক ও পলায়নপর। বৈঠকটিও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে ছিল না। তিনি অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও ঢাকায় আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের জন্য চাপ দেন এবং পাকিস্তানের গণমাধ্যমে সোভিয়েতবিরোধী প্রচারণা ও সারা দেশে সোভিয়েতবিরোধী বিক্ষোভের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
যখন আমি তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব পাকিস্তানের ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয়ে আলোচনায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলাম, তখন ফোমিন পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত অত্যন্ত উত্তেজনাকর, এ কথা স্বীকার করে বললেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন আশা করে যে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে কোনো অঘটন ঘটবে না। আমার জবাব ছিল, আমরা আশা করি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে।
দূতাবাসে ফিরে এসেই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে শুনতে পাই যে সীমান্তে ব্যাপক আকারে উত্তেজনা শুরু হয়ে গেছে। উপমহাদেশে যখন যুদ্ধ চলছিল, আমি নিরলসভাবে সোভিেয়ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছি। কখনো আমাকে সেখানে তলব করা হয় পাকিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী বিক্ষোভের প্রতিবাদ জানাতে, কখনো সোভিয়েত নাগরিকদের নিরাপদে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সহায়তার অনুরোধ করতে। আমি বলতে পারব না যে বৈঠকগুলো মধুর না তিক্ত হবে। কিন্তু সোভিয়েতরা সব সময় সৌজন্য ও সদাচরণের উঁচু মান রক্ষা করে চলতেন। যেসব বৈঠক আমার উদ্যোগে হতো, অবশ্যই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, আমি চেষ্টা করতাম অন্তত সোভিয়েতদের অনমনীয় মনোভাবকে কিছুটা নমনীয় করতে। বলা বাহুল্য, আমার সেই চেষ্টা পুরোপুরি অসফল হয়েছিল। এবং সোভিয়েতদের আধিপত্যবাদী স্বার্থের কাছে আমার দেশের স্বার্থ বিকিয়ে যাওয়ায় অসহায় দর্শকের ভূমিকা নেওয়া ছাড়া আমার কিছুই করার ছিল না।
যখন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ করল, তখন তা আমাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের ‘কুখ্যাত’ সিদ্ধান্তের কথাই মনে করিয়ে দেয়। দখলদার নাৎসি বাহিনী পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত লাল ফৌজ ওয়ারশতে তাদের অভিযান চালিয়ে যেতে থাকে। এ ক্ষেত্রে পোলিশ প্রতিরোধ বাহিনীর দুটি প্রধান ত্রুটি ছিল যে প্রথমত তারা মস্কোপন্থী ছিল না, দ্বিতীয়ত ওয়ারশ দখলে তারা সোভিয়েত বাহিনীকে সহায়তা করেছিল।
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ চলাকালে আমি কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ইরান, ফ্রান্স, আলজেরিয়া, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ উল্লেখযোগ্য বন্ধু দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতাম। কিন্তু তাদের পক্ষে সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো কিছু পাওয়া অসম্ভব ছিল, তাদের রক্ষণশীল ভারতপন্থী নীতির বার্তা ছাড়া। উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়ে যাওয়ার পর সোভিয়েতরা শান্তি রক্ষার বড় প্রবক্তা হলো, তখন তাদের মনোভাব হলো যেকোনো বিষয়ে, যে কারও সঙ্গে তারা আলোচনা করতে প্রস্তুত।
নভেম্বরের শুরুতে যখন ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চরম পর্যায়ে, তখনই ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম ম্যানেকশ মস্কোয় আসেন। সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তির ৯ নম্বর ধারার আলোকে (যাতে তৃতীয় কোনো দেশ দ্বারা কোনো পক্ষ আক্রান্ত বা আক্রান্ত হওয়ার হুমকি আছে মনে করলে অন্য পক্ষের সহায়তা নেওয়ার কথা আছে) তিনি তাঁর প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন। একদিন সন্ধ্যায় ম্যানেকশ উর্দি পরা সোভিয়েত জেনারেলদের সঙ্গে নিয়ে ব্যালে দেখতে গেলেন, আমি ও আমার স্ত্রী ডায়নাও সেখানে যাই একই উদ্দেশ্যে। যেহেতু ম্যানেকশ আমাদের পারিবারিক বন্ধু, সেহেতু তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ খুঁজছিলাম। শ্যাম আমাদের দেখে খুব উৎফুল্ল হলেন এবং আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। যখন দুই দেশ যুদ্ধে লিপ্ত, তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ও ভারতীয় সেনাপ্রধানের এই সখ্য আমন্ত্রকদের মনোযোগ কাড়ে। যদিও আমরা কথা বলছিলাম একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে এবং মাতৃভাষা গুজরাটিতে, শ্যামের হিন্দিভাষী সফরসঙ্গীরা ঠিকই তা সোভিয়েত কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।
পরদিন সকালে ফোমিনের সঙ্গে বৈঠকের শেষ পর্যায়ে তিনি গেল সন্ধ্যায় আমার ও শ্যামের সাক্ষাতের কথা উল্লেখ
করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে’? এবং কপট হাসি হাসলেন। আমি জবাব দিলাম, ‘তোমার বন্ধুরা কি তোমাকে বলেননি?’
পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ ও টালমাটাল অবস্থায় সোভিয়েত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আমাকে যথাসম্ভব তাদের মনোভাব নমনীয় করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু আমি যখন ক্রেমলিন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করতে যাই, তখন টের পাই যে সেখানে আমার উপস্থিতি কতটা প্রান্তিক। ১১ ডিসেম্বর ফোমিনের সঙ্গে বৈঠককালে আমাকে ফরমান আলীর প্রস্তাব ( যুদ্ধবিরতি) সম্পর্কে জানানো হয়, যে বিষয়ে আমি তখন পর্যন্ত কিছু জানতাম না। আমি অবিলম্বে টেলিগ্রাম করে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানালাম। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি। এরপর আমি ফোমিনের কাছ থেকে ফলোআপ রিপোর্ট পেলাম যে রাও ফরমান আলী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটি মূলত প্রেসিডেন্টের নির্দেশক্রমে। একই সময়ে আরেকটি বৈঠকে ফিরুবিন নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করা পোলিশ প্রস্তাব সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেন এবং এটি গ্রহণ করার সুপারিশ করেন। আমি এটি সম্পর্কেও কিছু জানতাম না বলে মতামত দিইনি। অশ্রুসজল ভাষণের পর কাগজপত্র ছিঁড়ে নিরাপত্তা পরিষদ অধিবেশন থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বেরিয়ে আসার পর অবশ্যই এই প্রস্তাবটি তীব্র বিতর্কের জন্ম দেয়।
নিরাপত্তা পরিষদকক্ষে ঢোকার আগেই পাকিস্তান প্রতিনিধিদল পোলিশ প্রস্তাবটি নাকচ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমার ধারণা, দুটি কারণে এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। প্রথমত, সেই উত্তেজনাকর সময়ে কারও পক্ষে ধীরস্থিরভাবে ভাবনার সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয়ত, ভুট্টোর মতো ব্যক্তির, যঁার সাহস ও রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্ত্বিত্ব আছে, এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে এগোতে পারতেন। তিনি নিরাপত্তা পরিষদে যে কাগজপত্র ছিঁড়েছেন, তা পোলিশ প্রস্তাব ছিল না, ছিল তাঁর ভাষণের খসড়া বা নোট। কিন্তু সেটি করে তিনি চরম নাটকীয়তার
জন্ম দিয়েছেন।
এখন দেখা যাক খসড়া প্রস্তাবের মূল কথা কী ছিল। (জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ডকুমেন্ট এস/১০৪৫৩/রেভ,১, পোল্যান্ড; রিভাইজড ড্রাফট রেজল্যুশন, অরিজিনাল ইংলিশ, নিরাপত্তা পরিষদ ১৬১৪তম অধিবেশন, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১)। এতে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠা ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনের কথা বলা হলেও কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। কীভাবে সেটি করা হবে তার রূপরেখাও ছিল না। এই প্রস্তাব গ্রহণ করার অর্থ হতো একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে পাকিস্তান সরকারকে তার দেশের বৃহৎ অংশের দখলদারি আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেওয়া এবং অনুমোদন করা, ইতিহাসে যার নজির নেই। যাই হোক, ১৫ ডিসেম্বর ১৭০০টায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয় এবং পরদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
অগৌরবের আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এবং নিউইয়র্ক থেকে উড়ে এসে ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে শপথ নেন। স্বাভাবিকভাবেই ভারত বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় এবং সোভিয়েতদের উৎসাহে পূর্ব ইউরোপীয় কয়েকটি দেশও তাকে অনুসরণ করে। এরপর কমনওয়েলথভুক্ত কিছু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে ভুট্টো দ্রুত তার প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং কমনওয়েলথ থেকে পাকিস্তানের সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নেন। বাংলাদেশকে অনিবার্য স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে সোভিয়েতের বিষয়েও ভুট্টো সেই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। কিন্তু আমি ভয়ের কারণ দেখিনি এ কারণে যে দূরদর্শী ভুট্টো সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন এবং আমাদের সমস্যা সমাধানে দেশটিকে অন্তর্ভুক্ত করার উপায় ভেবেছেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর খুব বেশি সময় না নিয়েই তিনি মস্কোর আতিথ্য গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
=======================================
৬। বইয়ের নাম : বাংলাদেশ কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস।
ড. কামাল হোসেন
.
আইনজীবী ও বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান কামাল হোসেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে ঐতিহাসিক ছয় দফা থেকে স্বাধীনতা লাভ এবং মুজিব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে লব্ধ অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন তিনি তাঁর বইয়ে।
বাংলাদেশ কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সবে সন্ধ্যা নেমেছে। এর একটু বাদেই আমার সেলের দরজা খুলে গেল। একজন সামরিক কর্মকর্তা প্রবেশ করলেন। তিনি সামরিক সদর দপ্তর থেকে আমার জন্য একটা বার্তা বয়ে এনেছেন। একটি সাদামাটা কাগজে টাইপ করা। যেখানে লেখা সদর দপ্তর, সামরিক আইন প্রশাসক অঞ্চল এফ। তারিখ ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। বিষয়: বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার।
১. এতদ্দ্বারা আপনাকে অবহিত করা হচ্ছে যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে আপনার বিচার করা হবে। জননিরাপত্তা এবং জনশৃঙ্খলার অনিষ্ট সাধন (এমএলআর ১৬ক) ইত্যাদির দায়ে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
২. যথাসময়ে আপনাকে অভিযোগপত্র এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের সারাংশ সরবরাহ করা হবে। সেই কাগজটি সামরিক আইন প্রশাসকের পক্ষে সই করেছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওয়াজির খান মালিক। এই পত্রটি বইয়ের শেষে সংযোজন করা হলো।
আমি অনতিবিলম্বে এর প্রতিবাদ করলাম। বললাম বাদীপক্ষের নোটিশ এভাবে কখনো অস্পষ্ট এবং ‘ইত্যাদির’ মতো কোনো উন্মুক্ত বিষয় হতে পারে না। কর্মকর্তাটিকে মেজর পদবির বলেই প্রতীয়মান হয়েছিল। তিনি উত্তর দিলেন যে নোটিশ কীভাবে দিতে হয়, সেটা তাঁর জানা নেই। ...তবে জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আমি একটি পিটিশন দাখিল করতে পারি। আমি যখন জেল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলাম, আমি এ পিটিশনে কাকে সম্বোধন করতে পারি। আমাকে তখন বলা হয়েছিল, ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের’ কাছে আমি পিটিশন দাখিল করতে পারি।
আমি আমার পিটিশনের কোনো উত্তর পাইনি। কিন্তু আমাকে অবহিত করা হয়েছিল যে আমার পরিবারের সদস্যরা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতে পারেন। আমার অন্তরীণ থাকার সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত ছিল যেদিন আমার মা, বোন, আমার স্ত্রী হামিদা, আমার দুই কন্যা টিনা, যার বয়স দুই বছর এবং চার বছর বয়সের সারাকে বেষ্টনীর মধ্যে দেখতে পেলাম।
...আমি বিচার শুরুর অপেক্ষায় থাকলাম। জেল সুপার আমাকে অবহিত করেছিলেন যে জেল হাসপাতালের একটি কক্ষকে আদালতকক্ষে পরিণত করার জন্য একটি সামরিক টিম এসে পৌঁছেছে। অক্টোবরের শেষ দিকে আমাকে বলা হয়েছিল জেল হাসপাতালের সেই কক্ষে যাতায়াতের অনুমোদিত পথ মহড়া দিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে শিগগিরই আমার বিচার শুরু করা হবে। কিন্তু প্রায় ১০ দিন পর আমাকে বলা হলো যে সামরিক টিম, যারা আদালতকক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং আমার বিচারের ব্যবস্থা করেছিল, তারা আকস্মিকভাবে চলে গেছে। ...নভেম্বরের শেষ দিকে এটা প্রতীয়মান হয়েছিল যে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আমাকে বলা হলো এটা হলো ‘বেসামরিক প্রতিরক্ষা’ গ্রহণের প্রস্তুতি। ১ ডিসেম্বর থেকে সমগ্র জেল চত্বরে ব্ল্যাকআউট শুরু হয়েছিল।...
এরপর নাটকীয়ভাবে সাইরেন ধ্বনি নীরব হয়ে গেল। ব্ল্যাকআউটের কারণে পুরো কারাগার এলাকায় যে গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছিল, তা রাতারাতি উধাও হয়ে গেল। সেখানে বরং আগের মতোই উদ্ভাসিত হলো উজ্জ্বল শক্তিশালী আলো। এটা ছিল তেমনই এক আলোকসংকেত যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ...১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ জেল সুপার আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে উষ্ণ এবং আন্তরিক মনোভাব প্রদর্শন করলেন। আমার ভালো-মন্দের ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। তিনি আমার সেলে ঢুকে বিস্ময় প্রকাশ করলেন যে সেখানে হাতলযুক্ত কোনো চেয়ার নেই। মেঝেতে কার্পেট নেই। তিনি আদেশ দিলেন অনতিবিলম্বে এসব সরবরাহ করতে। ...কিন্তু যখন আমি বাইরের বিশ্বের খবর জানতে চেয়েছি তখন আমাকে বলা হয়েছে এসব বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে তাঁর বারণ রয়েছে। তিনি শুধু এটুকু বললেন, এখানে থাকার মেয়াদ আর হয়তো দীর্ঘ নয়। এর প্রমাণ মিলল ২৮ ডিসেম্বরে। তিনি বললেন, আমি আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে পারি। কারণ, তিনি একটি নতুন আদেশ লাভ করেছেন। আমাকে ‘একটি নতুন অবস্থানে’ স্থানান্তর করা হবে। আমি উল্লসিত হলাম।...
আমাকে গাড়িতে তোলা হলো। দুজন প্রহরীর একজন আমার পাশে বসলেন। অপরজন বসলেন চালকের পাশের আসনে। অল্প দূর যাওয়ার পরেই আমি বুঝতে পারলাম, একটি সামরিক ট্রাক, যেখানে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন, তাঁরা আমাদের গাড়িটি অনুসরণ করছেন। আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক অজানা গন্তব্যে।
গাড়িটি যখন মহাসড়কে প্রবেশ করল, তখন আমি এটি চিনলাম—রাওয়ালপিন্ডির হাইওয়ে। গাড়ি রাওয়ালপিন্ডির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন হলাম, আমার উদ্বেগ তীব্র হলো যখন দেখলাম এটাকে বাইপাস করা হলো। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। আমার গন্তব্য তখনো অজ্ঞাত। হাইওয়ে ছাড়িয়ে কিছুদূর চলে এসে গড়িটি হঠাৎ মোড় নিল। এবং আমরা পড়লাম একটি কাঁচা সড়কে। আমি আমার এসকর্টের দিকে তাকালাম। সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমার প্রশ্নের মধ্যে শঙ্কা প্রকাশ পাওয়ায় তিনি বললেন, আপনি সেটা পছন্দ করবেন। আর তখনই আমি লক্ষ করলাম যে সশস্ত্র জওয়ানরা মেশিনগান তাক করে গাড়িটি ঘিরে ফেলল।
বিপদ অত্যাসন্ন ভেবে আমি নির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি? একটি ছোট বাংলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হলো। এসকর্ট বললেন, আমরা ওখানে যাচ্ছি। এবং আবার পুনরাবৃত্তি করলেন, আপনি সেটা পছন্দ করবেন। সশস্ত্র প্রহরীরা গাড়িটির জন্য পথ করে দিলেন এবং সেটি বাংলোর দিকে এগিয়ে চলল। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এগিয়ে এলেন এবং আমাকে বাংলোর দিকে যেতে বললেন। আমি বাংলোয় প্রবেশ করামাত্রই তিনি এক সারি কক্ষের প্রতি দিকনির্দেশ করলেন। আমাকে ১ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করতে বললেন। আমি তা-ই করলাম। এবং আমি দ্রুত আবেগের অাতিশয্যে আপ্লুত হলাম। কারণ, সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি আমাকে আলিঙ্গন করলেন এবং বললেন তিনি আমার জন্য সারাটা দিন অপেক্ষা করছেন। তিনি জানতে চাইলেন, আসতে কেন এত দীর্ঘ সময় লাগল? আমি তাঁকে বললাম, আমি নিজেকে দুপুরের আগেই প্রস্তুত করেছিলাম। আমি সন্ধ্যার আগে চূড়ান্তভাবে ছাড়া পাইনি। আর এখানে পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা লেগে গেছে।
জানতে পারলাম, আমরা যেখানে পৌঁছালাম, এটা হলো শিহালা পুলিশ একাডেমি চত্বর। রাওয়ালপিন্ডি থেকে দূরে নয়। বঙ্গবন্ধুকে এখানে আনা হয়েছিল দুই দিন আগে। তিনি উল্লেখ করলেন যে ১৬ ডিসেম্বরের অব্যবহিত পরেই মিয়ানওয়ালি জেল থেকে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। সেদিন কারাগারে উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছেছিল। কারণ, মিয়ানওয়ালি ছিল জেনারেল নিয়াজির নিজের শহর, যিনি ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছেন। পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, যিনি বঙ্গবন্ধুর দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি তাঁকে বলেছেন এই জেলে থাকা বঙ্গবন্ধুর জন্য নিরাপদ নয়। এবং তিনি (পুলিশ কর্মকর্তা) এখান থেকে তাঁর নিজের দায়িত্বে পুলিশ প্রহরায় তাঁকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেছেন। তিনি তখন বঙ্গবন্ধুকে এমন একটি স্থানে নিয়ে যান, যেখানে একটি বড় প্রকল্প সবে শেষ হয়েছে এবং সেখানে একাধিক বাংলো খালি ছিল।
বঙ্গবন্ধুকে সেখানে কয়েক দিন কাটাতে হয়েছিল। এরপর একটি হেলিকপ্টার এসে পৌঁছায়। এবং তারপর ২৬ ডিসেম্বরের দিকে তাঁকে শিহালায় নিয়ে আসা হয়। তিনি আমাকে জানালেন এখানে তাঁর পৌঁছানোর পরপরই ভুট্টো তাঁর সঙ্গে বাংলোতে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন তাঁকে ডিটেনশনে রাখা হয়েছিল কি না। ভুট্টো তখন তাঁকে বললেন, তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছে জানতে চাইলেন আপনি কী করে প্রেসিডেন্ট হলেন, জাতীয় পরিষদে আপনার চেয়ে আমি যেখানে দ্বিগুণ আসন লাভ করেছি। ভুট্টো বিব্রত হলেন এবং উত্তর দিলেন যে যদি তিনি (বঙ্গবন্ধু) চান এ পদ তাঁর জন্য ছেড়ে দিতে পারেন। বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, না। আমি তেমনটা হতে আশা করি না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি বাংলাদেশে ফিরতে চাই। ভুট্টো তখন তাঁকে বললেন, এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তিনি করবেন। তবে এ জন্য কয়েক দিন সময় দরকার। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বললেন কয়েক মাস আগে তাঁর বিচারের সময় আইনজীবীদের (মি. ব্রোহী এবং অন্যরা) মধ্যকার আলাপ-আলোচনা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কামাল হোসেনকেও নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। এবং তিনিও বিচারের সম্মুখীন। বঙ্গবন্ধু তখন ভুট্টোকে অনুরোধ করেন যে আমাকেও শিহালায় নিয়ে আসতে।
আর এভাবেই হরিপুর থেকে আমার মুক্তি ঘটে এবং শিহালায় আমাকে নিয়ে আসার বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হলো। এর পরবর্তী কয়েক দিন কেটে গেল বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ এবং বন্দোবস্ত করতে। এটা স্পষ্ট ছিল যে ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সামরিক জওয়ান যেহেতু বাংলাদেশে যুদ্ধবন্দী হিসেবে অবস্থান করছে আর সেটাই বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা এবং আশু প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা দেবে। সুতরাং প্রশ্ন দাঁড়াল এ জন্য প্রয়োজনীয় লজিস্টিক্যাল ব্যবস্থাদি ত্বরান্বিত করা। আজিজ আহমেদ, যিনি তখনো পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। তিনি বললেন যে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে একটি ঘোষণা দেবেন। আর এটা তিনি দেবেন করাচিতে একটি জনসমাবেশে
=====================
==========================
৭। বইয়ের নাম : উই হ্যাভ লার্নট নাথিং ফ্রম হিস্ট্রি, পাকিস্তান: পলিটিকস অ্যান্ড মিলিটারি পাওয়ার
.
লেখক : এম আসগর খান
একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় ঢাকা সফরে তিনি যে রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করেছেন, তাঁর উই হ্যাভ লার্নট নাথিং ফ্রম হিস্ট্রি, পাকিস্তান: পলিটিকস অ্যান্ড মিলিটারি পাওয়ার বইয়ে তার বিবরণ দিয়েছেন। সেখান থেকে চুম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হলো।
..
১৯৭১ সালে আমি দুবার ঢাকা সফর করি। একবার জুলাইয়ে, আরেকবার ডিসেম্বরে। সেখানে যা দেখলাম, তাতে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। নতুন মানুষ ক্ষমতায় এলেও সেখানে পরিস্থিতির কোনো উত্তরণ ঘটবে না, তা ছিল পরিষ্কার। পারস্পরিক ঘৃণা ক্রমেই বাড়ছিল। তা নিরসনে একরকম কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। জামায়াতে ইসলামী ১৯৭০ সালের নির্বাচনে খারাপ করলেও তারা ইসলাম রক্ষার নামে ইয়াহিয়া খানকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করছিল। তাদের ধারণা ভুল ছিল। তারা একটি অদ্ভুত যুক্তির অবতারণা করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে তারা যেহেতু দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে, তাই আওয়ামী লীগকে হটাতে বা শাস্তি দেওয়ার যেকোনো আয়োজনে তাদের যথাযথ গুরুত্বসহ যুক্ত করতে হবে। যদিও তারা পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনও পায়নি। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে যেসব রাজনৈতিক শক্তি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করছিল, তারা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপে সমর্থন দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী লীগকে শাস্তি দেওয়ায় তারা ইয়াহিয়া খানকে সহযোগিতাও করতে চেয়েছে। তারা ইয়াহিয়া খানকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা না করে তাঁকে আরও উৎসাহিত করেছে। যেন তিনি আরও প্রবল পরাক্রমে বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। জুলাইয়ে পূর্ব পাকিস্তান সফরের পর আমি ইয়াহিয়া খানকে চিঠি লিখেছিলাম।
কিছুদিন পর অ্যাবোটাবাদ সফরের সময় ইয়াহিয়া খান আমার সঙ্গে দেখা করেন। পূর্ব পাকিস্তানে যে বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সে সম্পর্কে আমি তাঁকে অবহিত করি। আমি তাঁকে বলি, এমনকি শেষ মুহূর্তে হলেও তাঁর রাজনৈতিক সমাধান খোঁজা উচিত। আর সাধারণ ক্ষমার আওতা বাড়ানো উচিত। উল্লেখ্য, তিনি ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের যে নেতারা দেশত্যাগ করেছেন, তাঁদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। যাতে তাঁরা দেশে ফিরে আসতে পারেন। আমি তাঁকে আরও বলি, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে তিনি নিজেই যে আইন প্রণয়ন করেছিলেন, তার আওতায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। কিন্তু তাঁর কাছে অহম ও ক্ষমতালিপ্সা পাকিস্তানের চেয়েও প্রিয় ছিল।
বোঝা-ই গেল, আমার পরামর্শ তাঁর মনঃপূত হয়নি। তারপর আমি বললাম, অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পরিবর্তন করা উচিত। কারণ, টিক্কা খান ইতিমধ্যে সেখানে একজন ঘৃণিত মানুষে পরিণত হয়েছেন। তাঁর নাম হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে গিয়েছিল। আমি লে. জেনারেল আজম খানের নাম প্রস্তাব করি। তিনি আইয়ুব খানের সময় অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের মনে ছিল এম এ মালিকের নাম। আমি বললাম, মানুষ তাঁকে ইসলামাবাদের শাগরেদ হিসেবেই মনে করবে।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত এম এ মালিকই গভর্নর হলেন। তাঁর নিয়োগের পর আবার আমি পূর্ব পাকিস্তানে যাই। সেবার তাঁর ব্যক্তিত্বের এক কৌতূহলোদ্দীপক দিক আবিষ্কার করি। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন, যেসব আসনে ১৯৭০-এর নির্বাচেন আওয়ামী লীগ জিতেছিল। তেহরিক-ই-ইসতিকলালের জাতীয় কার্যকরী কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় যে আমি পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে পার্টির পূর্ব পাকিস্তানের কার্যকরী কমিটির একটি সভা আহ্বান করব। সেখানে আলোচনা হবে, আমরা এই নির্বাচনে অংশ নেব কি না। আমি সেই আজ্ঞা পালন করলাম। তারপর আমাদের সিদ্ধান্ত ও দলের ইশতেহার আমরা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, পরদিন একটি পত্রিকায়ও আমাদের সংবাদ সম্মেলনের খবর ছাপা হলো না। অথচ প্রায় সব পত্রিকারই প্রতিবেদক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, সরকার আমাদের খবর না ছাপানোর নির্দেশ দিয়েছে। দৃশ্যত, সরকার চায় না আমাদের দল নির্বাচনে অংশ নিক। যেসব দল সামিরক সরকারের ধ্বজাধারী হয়ে থাকবে, সরকার চায় শুধু তারাই নির্বাচেন আসুক।
সেদিন বিকেলে গভর্নর এম এ মালিক আমাকে ফোন করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমি আমার সংবাদ সম্মেলনের খবর না ছাপানোর ব্যাপারে অভিযোগ করলে তিনি আমাকে বলেন, এটা তাঁর কাজ নয়। এটা নিশ্চয়ই ইসলামাবাদের আদেশে করা হয়েছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন আমার দল নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। আমি বললাম, সরকার নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় আমরা এতে অংশ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। এরপর মালিক তাঁর মন্ত্রিসভায় আমার দলের দু-একজনকে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন। আর তাঁর এ প্রস্তাবের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য তিনি কত কষ্ট করে তাঁর মন্ত্রীদের বাছাই করেছেন, সে বিষয়ে আমাকে ছবক দেন। তিনি নিজের গভর্নর হওয়া ও তাঁর মন্ত্রীদের বাছাই করার গল্পও আমাকে শোনান। যা হোক, আমার যা বোঝার আমি বুঝে যাই।
সেই সফরে আমাকে ঢাকার সামরিক আইন সদর দপ্তরেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমাকে বলা হয়, সেখানকার চিফ অব স্টাফ আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করবেন। এটা প্রস্তাব হিসেবে বেশ অদ্ভুত। আমি সেটা গ্রহণ করি। সেখানে গেলে একটি মানচিত্রের সাহায্যে আমাকে বোঝানো হয়, বর্ষাকালে সামরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি ঘটলেও তার এখন উন্নতি হওয়া শুরু হয়েছে। আমাকে জানানো হয়, জেনারেল হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে তারা আরও রাজাকার নিয়োগ দেবে। ফলে শুকনা মৌসুমে মুক্তিবাহিনীকে বাগে আনা যাবে। জেনারেলরা বলেন, তাঁরা এ কাজ চার থেকে ছয় সপ্তাহে করে ফেলতে পারবেন। তাঁরা কোন পথে কাজ করবেন, সে সম্পর্কেও তাঁরা আমাকে জানান। এরপর প্রথাগত সামরিক কায়দায় আমাকে বলা হয়, কোনো প্রশ্ন আছে কি না। আমি বললাম, তারা কী সমস্যা মোকাবিলা করছে, তা আমি জানি না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়টি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। ভারতের লক্ষ্য ও তার অংশগ্রহণের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখতে হবে। জেনারেলরাই বলেছেন, ভারতীয় বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ফলে তাদের সেনা পাঠানোর সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এক জেনারেল বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটা হলে তা ইসলামাবাদেরই সমস্যা হবে।’
রাওয়ালপিন্ডিতে ফিরে এক অনুষ্ঠানে আমার স্কুলবন্ধু ও চিফ অব জেনারেল স্টাফ অব দ্য আর্মি গুল হাসান খানের সঙ্গে দেখা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হলে তিনি আমার পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা খারাপ। তাঁরা বলেন, এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে যুদ্ধ শুরু করতে হবে। ‘কেন?’, আমি জিজ্ঞাসা করায় তিনি উত্তর দেন, ‘যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য।’ আমি স্মৃতি হাতরে দেখলাম, তিনি আসলে জান্তার সুরে কথা বলছেন। তাঁর মতো তিনিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ লেগে গেলে যুক্তরাষ্ট্র এসে হস্তক্ষেপ করবে। ইয়াহিয়া খান চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছেন। দেশ দুটিকে একত্রে বসাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ফলে ইয়াহিয়া খান ভেবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চাপ দিয়ে বৈরিতা বন্ধে বাধ্য করবে। অথবা ভারত ও পাকিস্তানকে এক টেবিলে বসিয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করবে। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনা প্রবেশের ঠিক আগেই এক টিভি ভাষণে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, তিনি আশা করেন, ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানে যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, বিশ্বশক্তি তা বন্ধে হস্তক্ষেপ করবে।
কিন্তু ইয়াহিয়া খান বুঝতে পারেননি, পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে দুনিয়ার আগ্রহ থাকলেও তারা পাকিস্তান রক্ষায় এগিয়ে আসবে না। ফল যা হওয়ার তা-ই হলো।
===============================
===============================
৮। বইয়ের নাম : দ্য ব্রিটিশ, দ্য ব্যান্ডিটস অ্যান্ড দ্য বর্ডার মেন,
লেখক : কে এফ রুস্তমজী,
কে এফ রুস্তমজী একাত্তরে ছিলেন ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মহাপরিচালক। তাঁর দ্য ব্রিটিশ, দ্য ব্যান্ডিটস অ্যান্ড দ্য বর্ডারমেন–এ উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বের কথা।
.
সব আলোচনা ভেস্তে গেল ২৫ মার্চ। পূর্ব পাকিস্তানিদের বেয়নেটের ভয় দেখিয়ে ইয়াহিয়া খান ফিরে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। যাওয়ার আগে যে ভাষণটি দিলেন, তার ছত্রে ছত্রে শুধু ক্ষোভ আর দম্ভোক্তি। মধ্যরাত থেকে শুরু হলো তাণ্ডব। মুজিবের ধানমন্ডির বাসা ঘেরাও করল পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা। মুজিব গ্রেপ্তার হলেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান মার্শাল ল জারি করলেন। কায়েম হলো ত্রাসের রাজত্ব। শুরু হলো ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। সেনাবাহিনী আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে নির্বিচারে হত্যা করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার ছাত্র ও কর্মচারীকে, ধর্ষণ করল নারীদের, বন্দী করল অগণিত মানুষকে। পাকিস্তানি সেনারা সবার আগে আক্রমণ চালায় জগন্নাথ হলে। ৬০০ থেকে ৭০০ হিন্দু ছাত্র ছিলেন সেখানে। নৃশংসভাবে ছাত্র-কর্মচারীদের হত্যার পর পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেখানেও হত্যা করল হাজার হাজার মানুষকে। প্রতিরোধের কোনো রকম সুযোগ না দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হলো ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বাঙালি সেনাদের। লে. জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগের সব নেতাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিলেন। গণহত্যায় কে কার চেয়ে এগিয়ে, তা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন দলের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হলো। বিদেশি সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিরা, যাঁরা এসব নারকীয় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তাঁদের হেনস্তা করতে লাগল পাকিস্তানি সেনারা। বিনা নোটিশে তাঁদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো।
...৩০ মার্চ সুস্পষ্ট নির্দেশনা পেলাম। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব উত্থাপন করলেন, তাঁর শেষ কথাগুলো ছিল, ‘এই হাউস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক উত্থান ঘটেছে। জয় তাদের সুনিশ্চিত। এই হাউস তাদের আশ্বস্ত করতে চায়, তাদের এই সংগ্রামে ভারতের আপামর জনতার আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন আছে।’
প্রধানমন্ত্রী যে বার্তা দিলেন, তা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত, ‘তোমরা আগাতে পারো, কিন্তু ধরা পোড়ো না।’ এর বেশি আর কিছু বললেন না। এত দ্রুত সবকিছু ঘটে যাচ্ছিল, কোনো কিছুই আগাম বলা সম্ভব হচ্ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনায় আমি কাজের স্বাধীনতা পেলাম। ফলাফলও আসতে শুরু করল শিগগিরই। রণাঙ্গনে প্রবেশ করল বিএসএফ। এই বাহিনীতে কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়াও ছিলেন ১০০ জন সেনাসদস্য। তাঁরা চোরাগোপ্তা হামলায় অংশ নিতে শুরু করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী মানুষকে সহায়তা দেওয়াই ছিল এ বাহিনীর কাজ।
ক্র্যাকডাউনের তিন দিনের মাথায় গোলক মজুমদার পূর্ব পাকিস্তান থেকে গোপন সূত্রে খবর পেলেন, আওয়ামী লীগের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা দীনহীন কৃষকের বেশে কুষ্টিয়ার দিকে আসছেন। তাঁদের মধ্যে সম্ভবত মুজিবও থাকছেন।
৩০ মার্চ একজন ইপিআর কর্মকর্তার চিরকুট হাতে পেলাম আমি। এটিই সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তান থেকে সাহায্যের জন্য পাওয়া প্রথম কোনো বার্তা। গোলক ৭৬ ব্যাটালিয়নের কর্নেল চক্রবর্তীর সঙ্গে কৃষ্ণনগরে গেলেন। বনপুর-গেদে সীমান্তে তাঁরা মেহেরপুরের সাব-ডিভিশনাল কর্মকর্তা তৌফিক ও সাব-ডিভিশনাল পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। পূর্ব পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বললেন, নেতাদের সঙ্গে এখনো তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। কারণ, টেলিফোনের সংযোগগুলো এখনো বিকল হয়ে যায়নি। তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হলো, তাঁরা কী ধরনের সাহায্য চান। উত্তরে তাঁরা বললেন, পেট্রল, কেরোসিন, টাকাপয়সা, অস্ত্রশস্ত্রসহ তাঁদের সব ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন। (১৪)
গোলক জানতে চাইলেন, তাঁরা এই যুদ্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু নেতার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন কি না। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার একটা জায়গা থেকে বেরিয়ে এলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীনকেই উত্তরসূরি হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীনের সঙ্গে ছিলেন জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের প্রধান হুইপ আমীর-উল ইসলাম। দুজনেরই খালি পা, কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ, এলোমেলো চুল, পরনে লুঙ্গি আর একটা গেঞ্জি। তাঁরা হেঁটে ঢাকা থেকে এখানে এসেছেন।
‘আপনি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি গোলক মজুমদার।’ তাজউদ্দীন বললেন, ‘নিশ্চয়ই। আমাদের নেতা মুজিব ভাই বলেছেন সবাইকে ছড়িয়ে পড়তে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধের দায়িত্ব নিতে। মুজিব গ্রেপ্তার এড়াতে পারেননি। তিনি আমাদের বারবার বলেছেন এমন কিছু না করতে, যাতে ভারতকে বিব্রত হতে হয়। চীনকে উত্তেজিত করা বা আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় এমন কিছু করতে তিনি আমাদের নিষেধ করে দিয়েছেন।’
গোলক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা আমাদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেন? আমরা কী করতে পারি? আপনারা কি আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যেতে চান?’
তাজউদ্দীন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি জানান, তাঁকে তাঁর মানুষের জন্য থেকে যেতে হবে। গোলক তাঁকে জানান, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা তাঁকে খুঁজে বের করে গুলি করে মারবে। এ কথা শুনে তাজউদ্দীন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আলোচনার জন্য ফিরে গেলেন এবং জানালেন, তিনি তাঁদের সঙ্গে কলকাতায় যেতে ইচ্ছুক।
গোলক আমাকে সবকিছু জানালেন। আমি কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিলাম। যখন কলকাতায় পৌঁছালাম, তখন ৩০ থেকে ৩১ মার্চের মাঝামাঝি একটা সময়, রাত ১২টার মতো বাজে। গোলক তাঁর চিরাচরিত হাসি দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। গোলক আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে আছেন। আপনি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান?’
অবশ্যই দেখা করতে চাই, এখনই চাই।
আমরা হেঁটে জিপের কাছে গেলাম। সেখানে তাজউদ্দীন বসে ছিলেন, সঙ্গে তাঁর নিরাপত্তার জন্য থাকা দুজন। আমরা তাঁকে ও আমীর-উল ইসলামকে আসাম হাউসে নিয়ে গেলাম। তাঁরা গোসল করলেন। আমি তাঁদের আমার কুর্তা ও পাজামা পরতে দিলাম। গোলক তাঁদের জন্য অমলেট করে নিয়ে এলেন। গোয়েন্দা সংস্থার উপপরিচালক রাজগোপাল আমাকে নিশ্চিত করলেন, চলমান যুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদই দ্বিতীয় ব্যক্তি। আমাদের জন্য তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরবর্তী দুই দিন আমরা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলাম। জানলাম পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে তাঁদের আলোচনার বিষয়েও। তাজউদ্দীন এ পরিস্থিতির জন্য পুরোপুরিভাবে ভুট্টোকে দায়ী করলেন। ইয়াহিয়া সমঝোতার ব্যাপারে নিমরাজি ছিলেন, কিন্তু সামরিক জান্তা ও ভুট্টোর বিরোধিতার কারণে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া আলোচনা ভেস্তে দিয়ে তাঁদের আশ্বস্ত করেছেন। সম্ভবত সবকিছু বুঝেও তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি আওয়ামী লীগের নেতাদের মনোভাব সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি সাফ জবাব দিলেন, তাঁরা স্বাধীনতা চান। পাকিস্তানি শাসকদের তাড়াতে তাঁদের যুদ্ধের পরিকল্পনা সম্পর্কেও শুনলাম আমরা। তিনি বললেন, পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করতে পূর্ব পাকিস্তানের সব মানুষ একতাবদ্ধ—এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
তাজউদ্দীন সীমান্ত এলাকায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। ১ এপ্রিল তিনি রাজগোপাল ও গোলককে নিয়ে কৃষ্ণনগরের কাছে একটি সীমান্ত ফাঁড়ি পরিদর্শনে গেলেন। আগে থেকেই এই পরিদর্শন সম্পর্কে যশোর সেক্টরের নেতৃত্বে থাকা মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে (কুষ্টিয়া-যশোর সেক্টরের কমান্ডার) জানানো হয়েছিল। মেজর ওসমান তাজউদ্দীন আহমদকে জানালেন, পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করতে তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ গোলাবারুদ নেই। তাজউদ্দীন আমাদের কর্মকর্তাদের দিকে তাকালেন। মনে হলো, মেজর ওসমানের কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যা বলব, তাতেই বোঝা যাবে আমরা যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা কতটা আন্তরিক। দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মেজর ওসমানকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিলেন। কী পরিমাণ গোলাবারুদ দরকার, তা-ও জানতে চাইলেন। ওসমান যখন তাঁর দলবল নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, তাঁদের দিকে তাকিয়ে তাজউদ্দীনকে বলতে শোনা গেল, ‘ওই যে ওরা যায়। আমাদের আশা আর অদম্য আকাঙ্ক্ষাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে গেল ওরা।’
সিদ্ধান্ত হলো তাজউদ্দীন ও অন্য নেতাদের নয়াদিল্লি নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হবে। গোলক তাঁদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। আমি আর গোলক নিউমার্কেটে গেলাম। সেখানে গিয়ে তাঁদের জন্য কাপড়চোপড়, ব্যাগ, সাবান, তেল যা যা লাগে কিনলাম। গোলক ঠাট্টা করে বললেন, ‘স্যার, আমরা এমনভাবে সবকিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে দিচ্ছি, কেবলই মনে হচ্ছে মেয়েকে জামাইবাড়ি পাঠাচ্ছি।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, গোলক, গত ২৩ বছরে নয়াদিল্লির মানুষ মুক্তিযোদ্ধা দেখেনি। সেখানকার বর্তমান প্রজন্মের নেতারা ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ ছাড়া কাউকে ঠিক ভালোভাবে নেবে না।
গোলক তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে ১ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে পৌঁছালেন। সেখানে তাঁদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিএসএফের সহকারী পরিচালক এস চট্টোপাধ্যায়। গোলক অন্য নেতাদের আনতে দ্রুতই আবার কলকাতায় ফিরে গেলেন।
৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। শুধু ভারতীয় নেতাদের সঙ্গেই নয়, তাঁরা দফায় দফায় বৈঠক করলেন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং নয়াদিল্লিতে থাকা পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গেও। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও সিরাজুল হক। এ ছাড়া ছিলেন নির্দিষ্ট কিছু সাংবাদিক। নয়াদিল্লিতে সপ্তাহ খানেক থাকার পর তাঁরা ৯ এপ্রিল কলকাতায় পৌঁছালেন। এবার তাঁরা আরও বলিষ্ঠ, আরও প্রত্যয়ী।
তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরে আসার পর তাঁর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাকে খঁুজে বের করা এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক সরকার গঠন করতে হবে। সরকার না হলে অন্য দেশ ও সরকারের কাছে সহায়তা পাওয়া যাবে না। এ ব্যাপারেও এ রুস্তমজী ও বিএসএফের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁকে সহায়তা করেন। যোগাযোগ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্নেল এম এ জি ওসমানী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এইচ এম কামরুজ্জামানের সঙ্গে। এরপর তাজউদ্দীন আহমদ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রূপরেখা নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয় এবং ১১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের প্রবাসী সরকারের ঘোষণা আসে। একই দিন তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে প্রথম যে বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন তা হলো, ‘আমরা এখন যুদ্ধে আছি। লাখো লাখো মানবসন্তানের লাশের স্তূপের নিচে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে।’ ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শপথ নেয়। তাজউদ্দীন আহমদই শপথস্থলকে মুজিবনগর হিসেবে উল্লেখ করেন। যে কারণে প্রবাসী সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।

Source>:Zakir's bcs

No comments:

Post a Comment