শিক্ষক নিয়োগে আবারো ঘাপলা



বেসরকারি হাইস্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বাছাইয়ে আবারো ঘাপলা

হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ বা এনটিআরএসসিএ শিক্ষক নিয়োগের জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় একজন প্রার্থীকে সর্বোচ্চ সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য বাছাই করা হয়েছে। এতে বঞ্চিত হয়েছেন  ছয়জন প্রার্থী। এভাবে অসংখ্য প্রার্থীকে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য পদের বিপরীতে মনোনীত দেখানো হয়েছে। এ নিয়ে বঞ্চিত প্রার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও
হতাশা বিরাজ করছে।
এনটিআরএসসিএ গত বছরের ৯ অক্টোবর প্রথম যখন শিক্ষক নিয়োগের বাছাই ফলাফল প্রকাশ করে তখন ঘটে মহাঘাপলার ঘটনা। চট্টগ্রাম বিভাগে একজন প্রার্থীকে ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য মনোনীত দেখানো হয়। ময়নসিংহের গফরগাঁও থানায় হাইস্কুল পর্যায়ে ৭৪টি পদে মনোনীত প্রার্থীর মধ্যে ৬৮ জনই একাধিক স্কুলে নিয়োগের জন্য বাছাই করা হয়। এভাবে ১২ হাজার ৬১৯ প্রার্থীর মধ্যে সাড়ে তিন হাজার প্রার্থীকে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য দেখানো হয়। এ নিয়ে সারা দেশে নিবন্ধনধারী লাখ লাখ প্রার্থীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করে তখন। এরপর আবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে নিয়োগের জন্য শিক্ষক বাছাইয়েও একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করল এনটিআরএসসিএ।
গত বছর ১৩ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ও ৭ ডিসেম্বর তৃতীয় ধাপে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সারা দেশে বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য পদের বিপরীতে মনোনীত শিক্ষকদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। দ্বিতীয় ধাপের তালিকায় দেখা যায় বরিশালে সজল কুমার শিকদার নামে একজন শিক্ষককে সাতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাতটি শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগের জন্য বাছাই করা হয়েছে। এগুলো হলোÑ ছোট রঘুনাথপুর হাইস্কুল বাকেরগঞ্জ, জিরাইল মাজিদিয়া আজিজিয়া বালিকা দাখিল মাদরাসা বাকেরগঞ্জ, বাকেরগঞ্জ গার্লস হাইস্কুল, লেঙ্গটিয়া মুসলিম মাধ্যমিক বিদ্যালয় মেহেন্দিগঞ্জ, নর্থ জঙ্গলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মেহেন্দিগঞ্জ, আমিরিগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মেহেন্দিগঞ্জ এবং সিএইচএমএস রহমান মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয় মেহেন্দিগঞ্জ।
প্রদীপ কুমার সরকার নামে আরেক প্রার্থীকে বাকেরগঞ্জের দু’টি স্কুলে নিয়োগের জন্য দেখানো হয়েছে যথাÑ মাচুয়াখালি শেরেবাংলা হাইস্কুল ও আফালকাঠি জে এ হাইস্কুল। এম মনিরুল আলম নামে আরেক প্রার্থীকে বাকেরগঞ্জের কৃষ্ণকাঠী হাইস্কুল ও উলিপুর হাইস্কুলের জন্য মনোনীত দেখানো হয়েছে।
তৃতীয় পর্বের তালিকায় দেখা যায় এমদাদুল হক মল্লিক নামে একজন প্রার্থীকে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার চারটি স্কুলের জন্য বাছাই করা হয়েছে। এগুলো হলোÑ আব্দুল মজিদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, গাজীপুর হাইস্কুল, শহীদ স্মরণিকা হাইস্কুল ও রাজাপুর হাইস্কুল।
দ্বিতীয় পর্বের ফলাফলে মো : মিরাজ মাকসুদুল্লাহ নামে এক প্রার্থীকে পিরোজপুর জেলার ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শূন্য পদে নিয়োগের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। এগুলো হলোÑ পসারিবুনিয়া এন এম কারিগরি দাখিল মাদরাসা ভাণ্ডারিয়া, ভোরা দাখিল মাদরাসা পিরোজপুর সদর, জামেয়া ফারুকিয়া দাখিল মাদরাসা ভাণ্ডারিয়া, ধাওয়া বাইতুল আমান দাখিল মাদরাসা ভাণ্ডারিয়া, গৌরিপুর হাজী লাহাজউদ্দিন দাখিল মাদরাসা ভাণ্ডারিয়া, চিত্রা পাঠাকাটা আঙ্গুলকাটা এসডি মাদরাসা মঠবাড়িয়া।
এ জেলায় রিপন চন্দ্র হালদার নামে আরেক প্রার্থীকে ভাণ্ডারিয়ার তিনটি স্কুলে নিয়োগের জন্য দেখানো হয়েছে দ্বিতীয় পর্বের ফলাফলে। এগুলো হলোÑ জুনিয়া হাইস্কুল, হেথালিয়া হাইস্কুল ও হেথালিয়া নেসারউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
এ ছাড়া মৃণাল কান্তি মিস্ত্রিকে মঠবাড়িয়া উপজেলায় তিনটি স্কুলে নিয়োগের জন্য দেখানো হয়েছে। এগুলো হলোÑ হটখালি আদর্শ জুনিয়র হাইস্কুল, পাঠাকাটা জুনিয়র হাইস্কুল ও নলিতুলাতলা জুনিয়র হাইস্কুল।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় সাইফুল হুদা নামে এক প্রার্থীকে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য মনোনীত করা হয়েছে দ্বিতীয় পর্বের ফলাফলে। এগুলো হলোÑ পাঁচুয়া রাবেয়া হাইস্কুল, বরইহাতি আঙ্গুরি হুরমাতউল্লাহ ফাজিল মাদরাসা, গয়েশপুর দারুল উলুম ফাজিল মাদরাসা ও বখুরা দাখিল মাদরাসা। পটুয়াখালী জেলায় মো: নেওয়াজ হোসেন নামে এক প্রার্থীকে চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য বাছাই করা হয়েছে দ্বিতীয় পর্বের ফলাফলে। এগুলো হলোÑ চংখোলা পাতাবুনিয়া জুনিয়র হাইস্কুল গলাচিপা, ছোট বাইশদিয়া ফজলুল করিম হাইস্কুল রাঙ্গাবালি, টুঙ্গিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় রাঙ্গাবালি ও উত্তর কাজির হাওলা মহসিনিয়া দাখিল মাদরাসা রাঙ্গাবালি।
এভাবে অন্য জেলার ফলাফলেও একই ঘটনা ঘটেছে। একজন প্রার্থীকে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য দেখানো হলেও ওই প্রার্থী যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন সেটি বাদ দিয়ে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো পরবর্তী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা। কিন্তু তাও করেনি এনটিআরএসসিএ। যেমন গফরগাঁওয়ে সাইফুল হুদা নামে এক প্রার্থীকে চারটি প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষকের শূন্য পদে নিয়োগের জন্য দেখানো হয়েছে। তিনি যে প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন সেটি বাদ দিয়ে বাকি তিনটি স্কুলের পদ শূন্য দেখিয়ে অপেক্ষমাণ প্রার্থীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার কথা তৃতীয় তালিকায়। কিন্তু সাইফুল হুদাকে যে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য দেখানো হয়েছে তার একটি প্রতিষ্ঠানের নামও তৃতীয় তালিকায় আসেনি। তার মানে তৃতীয় তালিকায় গফরগাঁওয়ের তিনটি প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষকদের তিনটি শূন্য পদে আরো তিনজন প্রার্থীর নাম আসতে পারত তা হলো না এনটিআরএসসিএর ভুলের কারণে। এভাবে একজন প্রার্থীকে একাধিক পদের বিপরীতে দেখানোয় বারবার নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন হাজার হাজার প্রার্থী। প্রথমত, একজন প্রার্থীকে একাধিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য বাছাই করা একটি ভুল অন্য দিকে পরের তালিকায়ও আসেনি একাধিক প্রার্থীর বিপরীতে থাকা প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদের নামগুলো। বারবার এভাবে একই ধরনের ঘাপলায় এনটিআরএসসিএর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে বঞ্চিত প্রার্থীদের মধ্যে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ অনিয়ম দূর করা এবং পরিচালনা পরিষদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য সরকার পিএসসির আদলে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করে সারা দেশে শিক্ষক বাছাই করার ঘোষণা দেয়। সে আলোকে সরকার এনটিআরএসসিএর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো নিবন্ধনধারীদের মধ্য থেকে শিক্ষক বাছাইয়ের উদ্যোগ নেয় গত বছর। এনটিআরএসসিএর নির্দেশ অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ১৪ হাজার ৬৬৯টি শূন্য পদের বিপরীতে চাহিদা পাঠানো হয় এনটিআরএসসিএর কাছে। এসব শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য নিবন্ধনধারী প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করে এনটিআরএসসিএ গত বছর জুন মাসে। আবেদনের নিয়মে বলা হয় একজন প্রার্থী যত খুশি স্কুল/কলেজ/মাদরাসায় আবেদন করতে পারবেন। সার্কুলার জারির পর নিবন্ধনধারীদের মধ্য থেকে সারা দেশে দুই লাখ ৪৯ হাজার ৫০২ জন প্রার্থী আবেদন করেন। যত খুশি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার সুযোগ রাখার ফলে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার ১৮৭টি আবেদন জমা পড়ে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ১৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য। যাচাই-বাছাইয়ের পর গত ৯ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ১২ হাজার ৬১৯ জন শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শূন্য পদের বিপরীতে। এতে দেখা যায়, একজন প্রার্থী ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য বাছাই হয়েছেন আবার ৭০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেও নিয়োগের জন্য বাছাই তালিকায় নাম আসেনি এক প্রার্থীর। অপর দিকে যত খুশি আবেদন করার নিয়ম রেখে বেকার যুবকদের কাছ থেকে প্রতি আবেদনের জন্য ১৮০ টাকা হারে এনটিআরএসসিএ আদায় করে নেয় ২৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।